রংপুরের গঙ্গাচড়া থানার ঠাকুরদহ মন্দির পাড়া এলাকায় ২০০৭ সালের ৩ জুলাই রুম্মান নামে এক শিশুকে হত্যার ঘটনা ঘটে।
১০ জুলাই হত্যাকারী সন্দেহে গ্রেফতার করা হয় পাশের বাড়ির গৃহবধূ মাজেদা বেগমকে। গ্রেফতারের পর বেআইনিভাবে মাজেদাকে ২ দিন থানায় আটকে রেখে ১২ জুলাই আদালতে হাজির করা হয়। শিশুটিকে গলা টিপে হত্যার কথা স্বীকার করে সেদিনই ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন তিনি। দীর্ঘ আট বছর পর ২০১৫ সালের ৭ মে মাজেদাকে ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। তার কোলে তখন ১৩ মাসের সন্তান।
রায়ের দিন ওই শিশু সন্তানকে কোলে নিয়েই আদালতে উপস্থিত হয়েছিলেন মাজেদা। কিন্তু রায়ে ফাঁসির আদেশ হওয়ায় মৃত্যু পরোয়ানার বোঝা মাথায় নিয়েই আদালতের নির্দেশে শিশু মারুফকে নিয়ে কনডেম সেলে ঢোকেন মাজেদা। এখনও তারা সেখানেই অবস্থান করছেন।
মামলার সব নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য পরের মাসেই মামলাটি হাইকোর্টে আসে। মামলার নথি দেখে খটকা লাগে উচ্চ আদালতের। কারণ, ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে মাজেদা গলা টিপে শিশুটিকে হত্যার কথা স্বীকার করলেও, সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের রিপোর্টে গলায় রশি পেচিয়ে রুম্মানকে হত্যার কথা বলা হয়। শুধু তাই নয়, শ্বশুরকে ফাঁসাতে এই হত্যা করেছিলেন বলে জবানবন্দিতে স্বীকার করেন মাজেদা।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, শ্বশুরকে ফাঁসাতে চাইলে খুন করে লাশ তার বাড়িতেই রাখতো পারতো মাজেদা। তা না করে কেন লাশটি পরিত্যাক্ত মন্দিরে নিয়ে গেল? মাজেদার জবানবন্দির গুরুতর এই ত্রুটি উঠে আসে উচ্চ আদালতের সামনে। তখন জানা যায়, পুলিশ তাকে ধর্ষণ ও তার সন্তানকে হত্যার হুমকি দিয়ে মিথ্যা জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে। পরে, বিষয়টি সামনে এনে আদালতের কাছে এই জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদনও করেছিলেন মাজেদা। তবে বিচারিক আদালত তা আমলে না নিয়ে তাকে ফাঁসির আদেশ দেন।
১৩ মাস বয়সে শিশু মারুফ মায়ের সাথে ঢুকেছিল কনডেম সেলে। এখন তার বয়স ৬ বছর। শিশু সন্তানসহ ৫ বছর চলমান মৃত্যু কুঠুরিতে থাকার পর অবশেষে প্রমাণ হলো মাজেদা নির্দোষ। জবানবন্দি মিথ্যা প্রতীয়মান হওয়ায় গত বুধবার ফাঁসির আদেশ থেকে তাকে খালাস দেন উচ্চ আদালত। নিরপরাধ হয়েও মায়ের সাথে সাথে তার জীবন থেকেও চলে গেছে অর্থহীন ৫টি বছর।
নিরপরাধ স্ত্রীর কারাভোগের জন্য যারা দায়ি তাদের বিচার চেয়ে মাজেদার স্বামী সাজু মিয়া বলেন, পুলিশ প্রশাসন যদি সঠিকভাবে তদন্ত করত তাহলে হয়ত আমার নিরপরাধ স্ত্রী ও সন্তানের এই শাস্তি পেতে হতো না। ছয়- সাত বছর ধরে তার যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রশাসনের কাছে তার ক্ষতিপূরণও দাবি করেছেন তিনি।
এখন প্রশ্ন হলো, পুলিশি হুমকির ভয়ে মিথ্যা জবানবন্দির কারণে নিরপরাধ মাজেদা ও তার শিশু সন্তানের জীবনে যে বিরাট ক্ষতিসাধন হলো- তা ফিরিয়ে দেবে কে? তাদের কনডেম সেলের সেই দুর্বিসহ সময়ের ক্ষতই বা কি দিয়ে পূরণ করা হবে? আর হুমকির মুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মিথ্যা জবানবন্দি আদায়ের প্রথাও কবে বন্ধ হবে?
নির্দোষ হলেও কনডেম সেলের সময়গুলো আর ফেরত পাবেন না মাজেদা। কিন্তু মিথ্যা জবানবন্দি আদায়ে পুলিশের অপতৎপরতা বন্ধ করার পরামর্শ দেন আইন বিশ্লেষকরা।
More Stories
২০ ডিসেম্বর থেকে করোনা টিকার চতুর্থ ডোজ
এই পদত্যাগে সরকারের কোনো ক্ষতি হবে না: তথ্যমন্ত্রী
মৃত্যু বেড়ে ১০৭ দেশে বন্যায়