30/09/2024

SkbTv Channel Bangla News

ইউক্রেন থেকে বেঁচে ফিরল ভারতীয় শিক্ষার্থীরা

Spread the love

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় কমছিল গাড়ির সংখ্যা। ইউক্রেন ছাড়তে বাস-ট্রেন পেতে শিক্ষার্থীদের চালাতে হচ্ছিল আরেক লড়াই। ওই কঠিন সময়ে এগিয়ে এসে যিনি শিক্ষার্থীদের ইউক্রেনের সীমান্ত পার হতে সাহায্য করেছেন তিনি মোয়াজ্জেম খান।
২৮ বছর বয়সী মোয়াজ্জেম পাকিস্তানের নাগরিক।তাঁর কথায়, তারা তো সবাই আমার ভাই-বোন। তাদের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করাকে সাহায্য বলতে লজ্জা লাগছে। আমি পাকিস্তানি বলে কোনো ভারতীয়কে সাহায্য করব না এতটা অশিক্ষিত, ছোট মনেরও হওয়া উচিত নয়।
হাজারখানেক ভারতীয় শিক্ষার্থীকে গাড়ির ব্যবস্থা করে বাড়ি ফিরতে সাহায্য করলেও মোয়াজ্জেমের ভাইসহ ভাতিজা, ভাতিজিরা আটকে রয়েছেন রুশ হামলায় বিধ্বস্ত পূর্ব ইউক্রেনের সুমি শহরে। তাঁর ভাই রয়েছেন কিয়েভের কাছে। আর মোয়াজ্জেম রয়েছেন পশ্চিম ইউক্রেনের টর্নোপিল শহরে।
মানবিক করিডর ছাড়া এখন সুমি শহর থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। ভাবিদের কাছে খাবার আছে। পরিস্থিতির একটু উন্নতি হলে উদ্ধার করে পোল্যান্ড পাঠানো বা পশ্চিম ইউক্রেনের কোনো শহরে নিয়ে আসার চেষ্টা চালাবেন তিনি।
গত এক দশক ধরে ইউক্রেনে পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মোয়াজ্জেম। সেই সূত্রে বেশ কিছুসংখ্যক ভারতীয় শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপ ছিল তাঁর।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের একটা দলকে সীমান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করার পর আমার ফোন নম্বর ছড়িয়ে পড়ে। দিনরাত গাড়ির জন্য ফোন আসতে থাকে। পরে যারা গাড়ি পাচ্ছিলেন না তাদের জন্য থাকার ব্যবস্থাও করতে থাকি। অসময়ে ১৮-১৯ বছরের ভাই-বোনদের একা ছাড়ব কোন বিবেকে।
অপরিচিত এতজনকে বাড়ি ফিরতে সাহায্য করলেও নিজের ভাইয়ের পরিবারকে কবে নিরাপদ জায়গায় তিনি নিয়ে যেতে পারবেন, সেই চিন্তায় ঘুম উড়ে গেছে মোয়াজ্জেমের।
মোয়াজ্জেম বলেন, রাশিয়ার হামলার আশঙ্কায় বিমানবন্দরে ভিড় বাড়ছিল। ওই সময় চার-পাঁচজন ভারতীয় শিক্ষার্থী বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারেন তাদের বিমানের ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। তখন গাড়ির জন্য ফোন করেন তারা। তাদের অবস্থান দেখে মোয়াজ্জেম বুঝতে পারেন, প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে রয়েছেন ওই শিক্ষার্থীরা। মোয়াজ্জেমের পক্ষে গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
তিনি আরো বলেন, ইন্টারনেটে ওই এলাকায় গাড়ি, দোকান, হোটেল সবার ফোন নম্বর খুঁজে ফোন করতে থাকি। অর্ধেক শহরকে সেদিন আমি ফোন করে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিলাম।
অবশেষে গাড়ি ঠিক করে ওই শিক্ষার্থীদের নিরাপদ জায়গায় পাঠান তিনি। পরের দিন সকাল থেকেই রুশ আগ্রাসন শুরু হয়ে যায়। তিনি বলেন, ওই দিন আমার ভাই টর্নোপিল এসেছিল। হামলা শুরু হতে ও ভাবিদের জন্য সুমি শহরের উদ্দেশে রওনা দেয়। কিন্তু বাড়ি পৌঁছতে পারেনি।
পর্যটন ব্যবসার জন্য বাস এবং ট্যাক্সি রয়েছে তাঁর। সেই গাড়িই শিক্ষার্থীদের ইউক্রেন থেকে বের করতে কাজে লাগান। কাজে লাগান ইউক্রেনে ব্যবসা সূত্রে গড়ে ওঠা যোগাযোগও। কত জন সাহায্যের জন্য ফোন করেছেন বা কত জনকে সাহায্য করতে পেরেছেন তার হিসাব রাখেননি। ঠিক যেমন এই কাজে কত খরচ হয়েছে তারও হিসাব করেননি তিনি।
তিনি আরো জানান, গত ১৫ দিনে বিভিন্ন দেশের হাজার তিনেক মানুষকে তো সাহায্য করেছিই। তাদের বেশির ভাগই সীমান্ত পেরিয়ে গেছেন। তার মধ্যে ৮০ শতাংশই ভারতীয়।
মোয়াজ্জেম বলেন, কত খরচ হয়েছে তার হিসাব করছি না, বেঁচে থাকলে আবার উপার্জন করে নেব। আমার লক্ষ্যই ছিল কাউকে ১ শতাংশ সাহায্য করতে পারলে সেটা করব।
মোয়াজ্জেমের সাহায্য নিয়ে গত ৭ মার্চ ইউক্রেন থেকে ভারতের ঝাড়খণ্ডের বাড়িতে ফিরেছেন মনমিত কুমার। তার মতে, ‘খান ভাই’ না থাকলে সময়মতো সীমান্তে পৌঁছতে পারতেন কি না সন্দেহ। ভারতীয় শিক্ষার্থী, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর কাছে গত কয়েক দিনে মোয়াজ্জেম খান হয়ে গেছেন ‘খান ভাই’।
মনমিত বলেন, ওই সময় ইউক্রেনে সব কাজেই বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছিল। কিন্তু বাসের জন্য আমাদের কাছ থেকে টাকাও চাননি খান ভাই।
বছর তিনেক আগে মোয়াজ্জেমের পর্যটন সংস্থার সঙ্গে ইউক্রেন ঘুরেছিলেন মনমিত। কিয়েভের বোগোমলেটস ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির ষষ্ঠ বর্ষের ছাত্রের কথায়, ‘সেই সময়ও তিনি আমাদের সঙ্গে দেশ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তখন তাঁর কথাগুলো সিনেমার সংলাপের মতো মনে হচ্ছিল। তিন বছর পর যে খান ভাই সেটা প্রমাণ করে দেখাবেন ভাবতে পারিনি। ভাগ্যিস তাঁর ফোন নম্বরটা মুছে ফেলিনি। তা হলে আর স্লোভাকিয়া সীমান্তে যাওয়ার বাস পেতাম না। ’
২৮ ফেব্রুয়ারি মনমিতদের ১৭ জনের একটি দল ট্রেনে পোল্যান্ড সীমান্তে পৌঁছানোর জন্য রওনা দিয়েছিল। পরে বুঝতে পারেন কারফিউর মধ্যে বাইরে থাকা নিরাপদ নয়।
কৃতজ্ঞ মনমিত বলেন, ট্রেন টার্নোপিলের ওপর দিয়ে যাবে জেনে খান ভাইকে বাসের জন্য ফোন করি। এককথায় তিনি রাজি হয়ে গেলেন। স্টেশনে নেমে দেখি আমাদের জন্য বাস দাঁড়িয়ে আছে।
সেই সময় ১৭ জনের বাসভাড়া দেওয়ার মতো নগদ অর্থ ছিল না তাদের কাছে। খান ভাইও তাদের কাছে পুরো টাকা চাননি। যদিও পরে পুরো টাকাই ট্রান্সফার করে দেন মনমিত।
কিছু পাওয়ার আশায় বা সাতপাঁচ ভেবে এই সব করেননি বলে জানিয়ে মোয়াজ্জেম বলেন, বিদেশের মাটিতে তো পাকিস্তান আর ভারতীয়দের মধ্যে কোনো সীমান্ত নেই। আমি ভারতীয় শিক্ষকের কাছে পড়াশোনাও করেছি। কিছু ঘটনা ভারত পাকিস্তানকে আলাদা করে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ইতিহাস নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। ইউক্রেনে আমরা ট্রেনে চেপে ভারতীয় কোনো বন্ধুর বাড়ি চলে যেতে পারি, তারাও আমাদের বাড়ি আসে। দুই দেশের সম্পর্ক এই রকম হলে কত ভালো হতো। দেশেও যখন-তখন বাসে-ট্রেনে চেপে বন্ধুর বাড়ি চলে যাওয়া যেত।
পাকিস্তানের তারবেলা শহরে বাড়ি মোয়াজ্জেমের। তিনি বলেন, আফসোস হয় যে দুই দেশের নাগরিকরা বিদেশে বেড়াতে আসেন। কিন্তু একে অন্যের দেশে বেড়াতে যান না। কত সুন্দর সুন্দর বেড়ানোর জায়গা আছে পাকিস্তানে। এখানে এলে এত ভালোবাসা পাবেন যে ভুলতে পারবেন না। আমার তো ইচ্ছা করে তাজমহল দেখতে। বন্ধুদের নিয়ে গোয়ায় আনন্দ করতে। পুরনো এক বন্ধু থাকে চেন্নাইয়ে। ভারতে যেতে পারলে তার বাড়িতেও একবার ঘুরে আসব।
সূত্র : আনন্দবাজার।

About The Author


Spread the love