দুপুর পার হয়া বিকেল হইল এলাও প্যাটত কিছু যায়নি। সকালে ভোকতে নাতি-নাতনি কান্দন করায় এক মুট আটা ছিল। তাই দিয়া চিতই ভাজি দিছি। সেই চিতই খায়া বিকেল পর্যন্ত আছে। বেটি-জামাই-নাতি-নাতনি মোর এটাই থাকে। জামাই এরশাদুল গেছে কাম খুঁজবার। কিছু আনলে তবেই সবার মুখে এক মুট খাবার যাবে না হলে উপোস থাকা নাগবে।’
এই কয়দিন কী খেয়েছেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যা আছিল তা একবেলা রান্না করে অল্প-অল্প করে সবাই খাচি। কাই জানে এমন হঠাৎ করি বান আসবে। সেজন্য কিছু জমাবার পাই নাই।’
উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নের হাতিয়া গ্রামের প্রায় সব মানুষের দুর্ভোগের চিত্র একই রকম।
কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি বাড়ছে নিম্নাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ ততই বাড়ছে। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটচ্ছে বানভাসীদের। বন্যাকবলিতরা নিজেদের এবং গবাদি পশুদের খাদ্য সংকট নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
তবে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম দাবি করেন, সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী বন্যাদুর্গতদের মাঝে বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।
বানের পানিতে অনেকেই পরিবার-পরিজন এবং গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আশ্রয় কেন্দ্র ও বাঁধের ওপর। বন্যা যতই দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে তাদের তিন বেলা পেট পুরে খাওয়া যেন স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো রকমে একবেলা জোগাড় করলেও সেই খাবার তিন বেলা খেতে হচ্ছে। না জুটলে উপোস থাকতে হয়।
নলকূপ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় পাওয়া যাচ্ছে না বিশুদ্ধ পানি। ফলে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ।
শুকনো খাবার পাউরুটি, চিড়া, মুড়ি, গুড়, কাঁঠাল খেয়ে দিন পার করছেন হাজারো বানভাসি মানুষ। নিজেদের খাদ্য আর গবাদিপশুর খাদ্য সংকটের কারণে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের।
বন্যার কারণে গ্রামীণ রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। বানভাসিদের অনেকের ভাগ্যে জোটেনি সরকারি-বেসরকারি কোনো সহায়তা।
সরেজমিন দেখা যায়, জেলার উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের হাতিয়া গ্রামের প্রায় ৩০টি বাড়ি পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। এসব বাড়ির লোকজন অনেকেই হাতিয়া বাঁধে আশ্রয় নিলেও কিছু-কিছু মানুষ এখনো পানির মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রয়েই গেছে।
তাদের মধ্যে এখানকার বাসিন্দা রেনুফা বেগম খাটের উপর সন্তান নিয়ে বসে প্লাস্টিকের বস্তা সেলাইয়ে ব্যস্ত। চারদিকে থৈ থৈ পানি আর পানি। দুই সন্তান আর মা রাহিলা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে পানির মধ্যেই ৬ দিন ধরে অবস্থান করছেন। কোমর সমান পানিতে মাচা বেঁধে এবং খাট উঁচু করে হাঁস-মুরগি নিয়ে এক ঘরেই বসবাস তাদের। পানি বাড়লে সেলাইকৃত বস্তায় শেষ সম্বলটুকু নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয়ের খোঁজে ছুটবেন।
কোমর সমান পানিবন্দি অবস্থায় খেয়ে না খেয়ে দিন অতিবাহিত করছেন তারা। জমানো খাবারটুকুও শেষ হয়ে গেছে। সকালে কোলের সন্তান দুটোকে এক মুট আটা দিয়ে চিতই করে ক্ষুধা নিবারণ করলেও সারাদিন কারোই মুখে অন্ন জোটেনি। স্বামী এরশাদুল ইসলাম গেছেন কাজের খোঁজে। কিছু জোগাড় করে আনলেই তবেই মিলবে মুখে উঠবে অন্ন। আর না হলে উপোসই রাতটুকু কাটাতে হবে পরিবারের সবাইকে।
রেনুফা বেগম বলেন, ৬ দিন ধরে পানির মধ্যে সবাই আছি। জমানো খাবার শেষ হয়ে গেছে। ছোয়ার বাপ গেছে বাইরে। কিছু আনলে পেটে যাবে না হলে অমতে থাকা নাগবে। শিশু ছোয়া হোক আর বড় মানুষ হোক কিছু করার নাই।
উঁচু স্থানে না যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পানি কমবে কমবে করিয়া আর যাওয়া হয়নি। পানি যদি আরও বাড়ে তাহলে সেলাই করা বস্তার মধ্যে জিনিস নিয়া যাওয়া নাগবে।
রিয়াজুল ইসলাম বন্যার কারণে পরিবার নিয়ে বাড়ি ছাড়া এক সপ্তাহ ধরে। ঘরের আসবাবপত্র ঘরের চালের সঙ্গে বেঁধে রেখে পরিবার ও গবাদি পশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধে। শ্রমিকের কাজ করে সংসার চলে। কিন্তু বন্যার কারণে হাতে নেই কাজ। ফলে দুর্দিনে কাটছে জীবন। পানি বেয়ে খড়ে নিয়ে যাচ্ছেন গরুর জন্য।
রিয়াজুল ইসলাম বলেন, কামলা দিয়া সংসার চালাই। বাড়িত পানি উঠছে জিনিস-জানাস ঘরের চালের সাথে বান্দি থুইছি। আর বাঁধের মধ্যে খেয়ে না খেয়ে পরিবার নিয়া আশ্রয় নিছি। এলা কোমর পানি ভাংগি গরুর জন্য পোয়াল (খড়) নিয়া যাই। বন্যার মধ্যে মানুষের খাবার এবং গরু-ছাগলের খাবারের জোগাড় করা কষ্ট হয়া গেছে।
মইজুন বেওয়া বলেন, আজ ৫-৬ দিন ধরি পানিত আছি। ঘরত হাঁটু পানি। হাঁস-চড়াই সোগ ভাসি গেছে। খায়া না খায়া দিন কাটপার নাগবে। কাইও দেখপার আসিল না। ইলিপ টিলিপ হামরা পাই নাই।
নৌকার মাঝি হাকিম মিয়া বলেন, বাড়িঘরে কোথাও কোমর আবার কোথাও বুক সমান পানি। টিউবওয়েল ডুবে গেছে। সেই বানের পানি খাওয়া নাগে হামাক গুলাক। কোনো উপায় নাই।
হাতিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শায়খুল ইসলাম জানান, এ ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে ৫-৯নং ওয়ার্ড। বন্যা কবলিতদের মাঝে এখনো পৌঁছায়নি কোনো সহায়তা। শুকনো খাবার, নিরাপদ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, স্যালাইনসহ একটি মেডিকেল মোবাইল টিম প্রয়োজন বলে জানান এই জনপ্রতিনিধি।
তিনি আরও জানান, চরাঞ্চলগুলোতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বন্যার সময় উঁচু স্থানে আশ্রয় নিতে। কিন্তু তাড়া গবাদিপশু কিংবা সম্পদ রক্ষায় এখন অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে যায়নি।
More Stories
যৌন উত্তেজক ওষুধ বিক্রির নামে প্রতারণা, তিনজন আটক I
এই পদত্যাগে সরকারের কোনো ক্ষতি হবে না: তথ্যমন্ত্রী
শিক্ষকের বেত্রাঘাতে গুরুতর জখম ছাত্র, থানায় মামলা