ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে পিরোজপুরের কাউখালী, ভাণ্ডারিয়া ও মঠবাড়িয়া উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
বুধবার (২৬ মে) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শুরু হওয়া জোয়ারে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। এতে তলিয়ে গেছে বাড়ি-ঘর, ফসলি জমি, পুকুর ও ঘের। এছাড়া জোয়ারের পানিতে পানিবন্দি কয়েক লাখ বাসিন্দা। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের প্রায় ২৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অস্বাভাবিক জোয়ারের কারণে কাউখালীর তিনটি ফেরিঘাটের গ্যাংওয়ে তলিয়ে গেছে। শিয়ালকাঠী ইউপির চেয়ারম্যান সিকদার দেলোয়ার হোসেন বলেন, দুপুরের দিকে জোয়ারের তীব্রতা খুবই বেশি ছিল। স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় ফুট বেশি উচ্চতায় কঁচা নদীর জোয়ারের পানি পাঙ্গাঁসিয়া বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে পানি প্রবেশ করেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছাঃ খালেদা খাতুন রেখা বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে মঙ্গলবার রাতে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ উপচে পানি ঢুকে পড়েছে। এসব এলাকার লোকজন রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছিল। এ ছাড়া বুধবার দুপুরে পানিবন্দি অসহায় পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
থেমে থেমে বৃষ্টি এবং জোয়ারের পানি বৃদ্ধির ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এ উপজেলার প্রায় ৫/৬হাজার পরিবার। বলেশ্বর নদের শাখা কঁচা এবং পোনা নদী তীরবর্তী এলাকার রেবিবাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় মঙ্গলবার রাত থেকে পানির তীব্রতা বেড়ে যায়। যার ফলে উপজেলার তেলিখালী, নদমুলা, ধাওয়া, গৌরীপুর, ইকরি, ভিটাবাড়িয়া ইউনিয়ন এবং ভাণ্ডারিয়া পৌর শহর সহ উপজেলার প্রায় কাঁচা, আধাপাকা এবং পাকা বাড়িঘরে পানি ঢুকে ওই সকল পরিবারের মানুষ পানি বন্ধি হয়ে পড়ে।
এদিকে সুপার সাইক্লোন ইয়াস মোকাবেলায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫৩টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত ছিল। এছাড়া ৭টি মেডিকেল টিম, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, রেড ক্রিসেন্ট এবং স্বেচ্ছাসেবক টিম প্রস্তুত ছিল। মঙ্গলবার রাতে কিছু কিছু আশ্রয়কেন্দ্রে যারা এসেছেন তাদের মাঝে স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা পরিষদের সমন্বিত উদ্যোগে শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, মোমবাতি, দেয়াশলাই, খাবার স্যালাইন সহ বিভিন্ন উপকরণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়। বিতরণকালে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং পৌর প্রশাসক সীমা রানী ধর,সহকারী কমিশনার ভূমি মো. তৌহিদুল ইসলাম, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আওলাদ হোসেন, উপজেলা প্রকৌশলী মো. বদরুল আলম এবং রেডক্রিসেন্ট সদস্যরা বিতরণ কাজে সহায়তা করেন।অন্যদিকে উপজেলা দুর্যোগব্যাবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জানান, অতিরিক্ত পানি বৃদ্ধির ফলে উপজেলায় কাঁচা, আধাপাকা ৩৫০০ এবং মোটামুটি পাকা ১৫০০ বাড়িঘর সহ প্রায় ৫,০০০ বাড়িঘরের ক্ষতি হয়েছে। কৃষিতে চলমান আউশ ধান চাষের মৌসুমে উপজেলায় প্রায় ১২/১৩শ হেক্টর জমির আউশের বীজতলা সহ ধানের মাঠ পানিতে তলিয়ে গেছে। ২৪শ খামারির মাছ পানিতে ভেসে গেছে। এছাড়াও পান বরজ এবং মৌসুমি সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে কোথাও প্রাণহানির কোন ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং পৌর প্রশাসক সীমা রানী ধর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং পৌর প্রশাসক সীমা রানী ধর জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মোকাবেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপি এর পরামর্শে আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছি।
উপকূলীয় মঠবাড়িয়ায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর প্রভাবে বলেশ্বর নদ তীরবর্তী চার ইউনিয়ন রক্ষা বেরিবাধ উপচে অর্ধশত গ্রামে প্লাবন ঘটেছে। বলেশ্বর নদ মধ্যবর্তী মাঝের চরের সাড়ে চার কিলোমিটার বেরিবাঁধ জোয়ারের তোড়ে সম্পূর্ণ ভেসে গেছে। মাঝেরচর, ক্ষেতাচিড়া জেলেপল্লী, বড়মাছুয়া, খেজুরবাড়িয়া, ভোলমারা , তুষখালী, ছোট মাছুয়া,জানখালী, বেতমোর, উলুবাড়িয়াসহ মিরুখালী বাজার ও তুষখালী ইউনিয়ন বাজারসহ অন্তত অর্ধশত গ্রামে বাধ উপচে লোকালয় জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর প্রভাবে মঙ্গলবার গভীর রাতে বলেশ্বর নদ তীরবর্তী উপজেলার বড়মাছুয়া ইউনিয়নের লঞ্চঘাট, ষ্টিমারঘাট এলাকার বেরিবাধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। বুধবার সকালে অতি জোয়ারে পানির চাপ বৃদ্ধি পায়। এতে কৃষিজমি ৩/৪ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। এছাড়া মঠবাড়িয়া পৌর শহরের দক্ষিণ বন্দর এলাকার খাল উপচে হুহু করে জোয়ারের পানি ঢুকে ব্যাপক এলাকাজুড়ে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। সহস্রাধিক পৌরবাসি পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। এসব পরিবারে আজ রান্নাবান্নাও বন্ধ। এছাড়া শহরের আজহার কলোনী এলাকায় খালের পানি ঢুকে ৩০০ পরিবারে দুর্ভোগের সৃষ্টি করেছে।
অপর দিকে বলেশ্বর নদ মধ্যবর্তী মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন মাঝের চর এলাকার জেলে পল্লীর তিন শতাধিক পরিবার এখনও আশ্রয় কেন্দ্র অবস্থান করছেন। মঙ্গলবার রাতে ঝড় ও জোয়ারের তোড়ে মাঝের চরের সাড়ে চার কিলোমিটার বেরিবাধ সম্পূর্ণ ধসে গিয়ে মাঝের চরে মহা প্লাবনের সৃষ্টি করেছে। বুধবারের জোয়ারে পুরো চরের বসতি ও বনাঞ্চল ৫/৬ ফুট পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়লে কয়েকশত পানিবন্দী পরিবার স্থানীয় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে আটকা পড়েন। এসব জেলে পরিবারগুলোর রান্না বান্না বন্ধ হয়ে পড়লে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাল ডালসহ খাদ্য উপকরণ ও গ্যাসের চুলা পৌঁছে দেন।
এসব এলাকার মানুষের পানিবন্দী নির্ঘূম রাত শেষে বুধবারের জোয়ারে আরও দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি, আউশ ধানের ক্ষেত ৪/৫ফুট পানির নিচে। পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে।স্থানীয় তরুণ সমাজ সেবক মাইনুল ইসলাম জানান, বড় মাছুয়া লঞ্চ ও স্টীমার ঘাট সংলগ্ন ভেরিবাধ ঝুকিতে রয়েছে। এছাড়া মাঝের চরের সাড়ে চার কিলোমিটার বাধ জোয়োরের তোড়ে সম্পূর্ণ ভেসে গেছে। ১২০ চরবাসি পরিবার এখন পানিবন্দি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড পিরোজপুর এর উপ সহকারি প্রকৌশলী মো. শাহ আলম বালি বলেন, বড় মাছুয়া বেড়ি বাধে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙ্গন রোধ করার চেষ্টা চলছে। এছাড়া ক্ষেতাছিরা কচুবাড়িয়া বাঁধে জোয়ারের তোরে কিছু জিও ব্যাগ ডিসপ্লেস হয়ওয়ার খবর পেয়েছি। তবে পর্যায়ক্রমে ছুটে যাওয়া বাঁধে সংস্কারের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
মঠবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঊর্মী ভৌমিক জানান, বলেশ্বর নদীর খেতাছিড়া মোহনা বাঁধ, বড়মাছুয়া মোহনা বাঁধ ও বলেশ্বর নদীর মাঝের চরের জেলে বসতির মানুষ জলমগ্ন হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।
More Stories
২০ ডিসেম্বর থেকে করোনা টিকার চতুর্থ ডোজ
এই পদত্যাগে সরকারের কোনো ক্ষতি হবে না: তথ্যমন্ত্রী
মৃত্যু বেড়ে ১০৭ দেশে বন্যায়